চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিশ্বের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কী প্রভাব ফেলবে, সেটি নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, এর ফলে সব মানুষেরই আয় ও জীবনমান বাড়বে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়াতেও ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন।
ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর অন্যতম বৃহৎ প্রতিশ্রুতি হলো, বিশ্বের জনগণের জীবনমান উন্নত করা এবং আয়ের স্তর বৃদ্ধি করা। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে যারা ইতিমধ্যে কানেকটেড নেটওয়ার্কের আওতায় আছে, তাদের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তিগুলো আরও পণ্য এবং পরিষেবা উপভোগের দুয়ার খুলে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন: মিস্টার শিটহোল ! জিনপিংকে অশ্লীল ভাষায় সম্বোধন ফেসবুকের, নেট দুনিয়া তোলপাড়
প্রযুক্তির বাজার বিকশিত করায়ও এর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। উদীয়মান প্রযুক্তি নতুন পণ্য ও পরিষেবা তৈরি করে তৈরি করছে নতুন চাহিদা ও তার জোগানের ব্যবস্থা। এসব আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ভোগবিলাস ও আনন্দ উপভোগ বাড়িয়ে তুলবে।
ক্যাব ডাকা, ফ্লাইট বুকিং, পণ্য কেনা, বাজার করা, অর্থ লেনদেন, সংগীত শোনা, ফিল্ম বা খেলা দেখা, এগুলোর কোনো কিছুই নতুন প্রযুক্তির আওতার বাইরে থাকবে না।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের কর্মক্ষেত্র এবং সংস্থাগুলো চৌকস বা স্মার্ট হয়ে উঠছে এবং আরও দক্ষ হয়ে উঠছে মেশিনগুলো। মেশিন ও মানুষের মিথস্ক্রিয়া আরও বাড়ছে, একসঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। সরবরাহ ব্যবস্থা, দ্রব্যতালিকা এবং স্টোর ব্যবস্থাপনার সংযুক্ত ডিভাইস ব্যবহার বাড়ছে।
এতে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যয় কমবে, স্থানীয় ও বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনগুলো আরও কার্যকর হয়ে উঠবে, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের খরচও কমবে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে।
ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। এগুলো সবই নতুন বাজার উন্মুক্ত করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
আরও পড়ুন: অতিরিক্ত চিপস খাওয়ার অভ্যাস বাড়াচ্ছে ক্যান্সারের ঝুঁকি! প্রমাণ মিলল গবেষণায়
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর প্রযুক্তিগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও ভালো প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করবে, উদ্ধার ও নজরদারির কাজকে সহজতর করবে। রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিকভাবে চাইলে চতুর্থ বিপ্লবের প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লব দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশের অবস্থা কিছুটা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আরও বেশি কারিগরি সক্ষমতা এনে দেবে এই প্রযুক্তিগুলো।
বিশ্ব জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের বেশি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত। তারা শিখতে ও শেখাতে এবং তথ্য-আনন্দ-বেদনা-দুঃখ-অভিজ্ঞতা-সাফল্য ভাগাভাগি করে নিতে সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। আদর্শ বিশ্বে এই মিথস্ক্রিয়াগুলো আন্তসাংস্কৃতিক বোঝাপড়া ও সংহতির সুযোগ করে দেবে।
অন্যদিকে নতুন তথ্যপ্রযুক্তি দ্বারা হাজির হওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো মানুষের গোপনীয়তা। কেন এটি এত প্রয়োজনীয়, তা আমরা সহজাতভাবে বুঝতে পারি। তবুও আমাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও তথ্যবণ্টন নতুন বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আগামী বছরগুলোতে এই মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক তীব্র হবে।
আসলে গোপনীয়তা রক্ষা করা খুব কঠিনই হবে। নতুন এই কঠিন পরিস্থিতিতে গোপনীয়তার সংজ্ঞাই বদলে যাবে। আগের মতো অনেক কিছুকে আর গোপনীয় বলে রক্ষা করতে পারব না আমরা। সবকিছুই খোলামেলা হয়ে গেলে মূল্যবোধকেও নবতর নিম্নস্তরে নামিয়ে এনে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন পড়বে।
একইভাবে জিন-সম্পাদনা, জৈবপ্রযুক্তি এবং এআইতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবগুলো জীবনকাল, স্বাস্থ্য, জ্ঞান এবং ক্ষমতার বর্তমান সম্পর্ককে পেছনে ঠেলে দিয়ে মানব হওয়ার অর্থ নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে। অর্থাৎ আমাদের নৈতিকতা ও নৈতিক সীমারেখাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে বাধ্য করবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর মতো বৃহত্তর প্রতিশ্রুতি কিংবা সম্ভাব্য মহাবিপদ নিয়ে আগের কোনো শিল্পবিপ্লব হাজির হয়নি। আজকের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই প্রচলিত সরলরৈখিক চিন্তায় জড়িয়ে পড়েন, তাঁদের মনোযোগ একাধিক সংকট দ্বারা ডুবে যায়। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎকে রূপদানকারী উদ্ভাবনের শক্তিগুলো সম্পর্কে কৌশলগত চিন্তা আরও গভীর করার সময় হয়েছে।
যান্ত্রিক মেধা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোনো নৈতিকতা দিয়ে চলবে না, সে চলবে অঙ্কের নিয়মে। মূল্যবোধহীন যান্ত্রিক মেধার অবারিত বিকাশ সামাজিকতার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তার বিলোপ ঘটাতে পারে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থান দখল করবে ব্যবসা।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে পুঁজির চাহিদাই মূল্যবোধে রূপান্তরিত হয়েছে এবং রাষ্ট্র সে মতে আইন পরিবর্তন করে লিবারেল সেজেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব পরিণত হলে পরে দেখা যাবে, মানবের সৃজনশীলতা উদ্ভূত অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তে যা আসে, তা-ই ধীরে ধীরে মূল্যবোধ বলে পরিগণিত হবে।
এতে সমাজে পাপের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে উঠতে পারে এবং মানব মননে পাপবোধ বলে কিছু অবশিষ্ট রইবে না। মানবমনের বিবিধ চাহিদাই হয়ে উঠবে মূল্যবোধের ভিত্তি।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র যখন উপনিবেশে সংঘাত সৃষ্টি করেছে ও লুটপাট অব্যাহত রেখেছে, তখন ইউরোপের বস্তুবাদী নাগরিক তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কেননা তাতে আর্থিক মুনাফার যোগ ছিল। আর্থিক মুনাফাই নৈতিকতার সীমা ঠিক করে দিয়েছিল।
পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো এভাবে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে যার বর্তমান নীতি হলো, ব্যক্তি ও ব্যবসার যেকোনো চাহিদাই নৈতিকতার ভরকেন্দ্র—হোক তা আগের মানদণ্ডে অনৈতিক বা বেঠিক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এর বিকাশমান সৃজনশীলতা, উদীয়মান প্রযুক্তিগুলো তেমন করে পুরোনো নৈতিকতার ভাঙনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে।
অন্যদিকে ব্যবসায়িক মুনাফার একমুখী চক্রে পড়ে প্রাণ ও পরিবেশগত নৈতিকতা আরও ধসে পড়তে পারে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে আমরা দেখেছি, উদ্ভিদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রজননের প্রক্রিয়াগুলোকে চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে বীজহীন ফল উৎপাদনকে বাণিজ্যিক বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
আর-পড়ুনঃ মেয়েদের ভ্রমণের ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে চাই, ওয়ান্ডার উইমেনের প্রতিষ্ঠাতা সাবিরা মেহেরিন
এমনকি এসবের স্বত্ববিহীন পুনরুৎপাদনকে বাণিজ্যিকভাবে অবৈধ করা হয়েছে। জেনেটিক্যালি মোডিফাইড উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রাকৃতিক সংরক্ষণগত অধিকার তো অস্বীকার করা হয়েছেই, উল্টো যেসব চাষি অতীতে নিজ শস্যবীজে চাষাবাদে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁদের বীজ ব্যবসার চক্রে ফেলা হয়েছে। ফলে উভয় দিক থেকেই অনৈতিকতাকে নৈতিকতায় রূপ দেওয়া হয়েছে।
এটা খুব সম্ভব যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের শেষ দিকে এসে আমরা কী করি তা-ই শুধু পরিবর্তিত হবে না, আমরা কারা থাকব, তা-ও বদলে যাবে। এটি আমাদের পরিচয় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্যাগুলোকে প্রভাবিত করবে। আমাদের গোপনীয়তার অনুভূতি, মালিকানাবিষয়ক ধারণা, ভোগের ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
আমরা কীভাবে কাজ করি, অবসর নিই, কীভাবে আমরা আমাদের পেশার উন্নতি করি, গড়ে তুলি আমাদের দক্ষতা, মানুষের সঙ্গে মিলি এবং সামাজিক সম্পর্ক লালন করি, এগুলো সবই রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে এবং আদতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যেই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসাসেবা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জিনপ্রযুক্তির অতিবিকাশের ফলে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবহারের সংঘাত তৈরি হবে।
দিনের শেষে আমরা চাই সিদ্ধান্তগুলো যাতে মানুষ এবং মূল্যবোধের কাঠামোর মধ্যে থাকতে পারে। আমাদের এমন ভবিষ্যৎ গঠন করা দরকার, যা মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধকে সবার আগে রাখবে। সিদ্ধান্তগুলো যেন বৈষম্যহীন ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সব মানুষের জন্য কাজ করে।
চরম হতাশাবাদী দৃষ্টিতে বলতে গেলে আশঙ্কা হয়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব একদিক থেকে মানবতাকে ‘রোবটাইজ’ করার যাত্রা এবং এর ফলে আমাদের হৃদয় ও আত্মাকে বঞ্চিত করার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
আর-পড়ুনঃ মুরগির মেটে বা লিভার খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারি না ক্ষতিকর? জেনে নিন
তাই মানবপ্রকৃতির মধ্যকার সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ: সৃজনশীলতা, সহানুভূতি, মমত্ববোধ ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যৎকে মানবিক গন্তব্যে রাখার ভিত্তিতে নতুন যৌথ এবং নৈতিক বৈশ্বিক উপলব্ধির বিকাশ ঘটাতে হবে। এটা নিশ্চিত করা আমাদের সবার কর্তব্য।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: সুইডেনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।